অনেক সময় আমাদের জীবনে কিছু মুহূর্ত এমনভাবে ধরা দেয়, যেগুলো তখন মনে হয় অপরিবর্তনীয়। ভুল বোঝাবুঝি হয়। রাগ, অভিমান, অব্যক্ত কষ্ট—সব মিলে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। তখন যে কথাগুলো বলি, যেভাবে বলি, সেটা তখনকার আবেগ থেকেই আসে। মনে হয়, “আর না। অনেক হয়েছে। ওর মুখটাও আর দেখতে চাই না।”
কিন্তু একটু সময় গেলে… সত্যি কি আমাদের সেই অনুভবগুলো আগের মতো থাকে?
সময় একটা আশ্চর্য জিনিস। সে শুধু ক্ষত তৈরি করে না, কখনও কখনও আস্তে আস্তে সেই ক্ষতের গা ছুঁয়ে আমাদের নতুনভাবে বুঝতেও শেখায়। একসময় হয়তো বুঝি—ঘটনাটা অন্যভাবে হ্যান্ডেল করা যেত। হয়তো বোঝা যেত, সেই মানুষটা যা বলেছিল, সেটার ভিতরকার মানে ভিন্ন ছিল। তখন বুঝে উঠতে পারিনি, কারণ তখন নিজের আবেগই ছিল সবচেয়ে বড়।
কিন্তু সত্যিটা হলো—সবাই পারে না নিজের ভুল স্বীকার করতে। কেউ পারে, আবার কেউ সাহস করেও পথ খুঁজে পায় না। কেউ ফিরতে চায়, কিন্তু জানে না কিভাবে। আবার কেউ কেউ ভাবতে থাকে, “ফিরে গেলে সব আগের মতো থাকবে তো?” এই দ্বন্দ্বে আটকে যায়। না পারে ফিরে যেতে, না পারে দূরে সরে থাকতে।
সব মানুষ একভাবে ভাবে না। কেউ সময়ের সাথে সাথে নিজের অবস্থান বোঝে, আবার কেউ হয়তো এখনো নিজের ইগোর দেয়ালে আটকে থাকে। নিজেকে বোঝাতে থাকে—“আমি যা করেছি, যা বলেছি, সব ঠিকই করেছি। I have no regrets.” কিন্তু ভিতরের কোথাও হয়তো একটা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে, নিঃশব্দে—
“আমি কি ঠিক করেছিলাম?”
এই প্রশ্ন সবার ভিতরে আসে না, কিন্তু যাদের মধ্যে সম্পর্কের প্রতি সত্যিকারের টান থাকে, তারা এক সময় না এক সময় থেমে ভাবতে বসে। খুব ব্যস্ত জীবনের মাঝখানেই হঠাৎ একটা pause আসে—অদৃশ্য, নরম, গভীর। আর সেই pause-এর ভেতরেই হয়তো জন্ম নেয় অনুশোচনা, অথবা একটা নীরব উপলব্ধি।
এই অনুভূতিগুলো অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে, যখন হঠাৎ কোনো পুরনো ছবি চোখে পড়ে। সেই এক ফ্রেম—পরিচিত হাসিমুখ, একসাথে কাটানো কোনো মুহূর্ত। তখন মনে হয়, “এগুলো কি সত্যিই ঘটেছিল?” অথচ ওই হাসিটা ছিল জেনুইন। ওই চোখে চোখ রাখার মুহূর্তটা ছিল সম্পূর্ণ সত্যি। তাই তো প্রশ্ন জাগে—
“How did we get from there to here?”
সেইসব সম্পর্ক হয়তো আর এখনকার জীবনের অংশ না, কিন্তু তারা কোথাও হারায় না। সব সময় চোখে পড়ে না, কিন্তু মনের গভীরে কোথাও যেন জমে থাকে। হঠাৎ কোনো রাতে, নিঃশব্দে, তারা ফিরে আসে।
আর তখনই হয়তো মাথায় বাজতে শুরু করে একটা গান—
“Let it be, let it be, let it be, let it be… Whisper words of wisdom, let it be.”
কিছু কিছু সম্পর্ক হয়তো শুধুই টিকে থাকে এইভাবেই—একটা স্থায়ী অনুপস্থিতির মতো। চোখের সামনে না থেকেও থেকে যায়। হয়তো আর ফিরেও আসে না, শুধু থেকে যায় একরকম pause হয়ে—যেটার কোনো ঠিকানা নেই, কোনো নাম নেই, শুধু একটা অনুভব আছে।
সবাই সবকিছু ঠিক করে নিতে পারে না। কিন্তু এই হালকা অনুতাপ, এই একফোঁটা নিস্তব্ধতা, এই নরম আত্মস্বীকারোক্তি… তারাই প্রমাণ করে—
সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না,
কিছু সম্পর্ক শুধু নিঃশব্দে pause হয়ে থাকে।